রমজান ও ঈদকে সামনে রেখে ভেজাল সেমাই তৈরির মহোৎসব
আসন্ন রমজান ও ঈদকে সামনে রেখে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ভেজাল সেমাই তৈরির মহোৎসব শুরু হয়েছে। এসব অসাধু ব্যবসায়িরা নিজেদের কারখানার প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে ‘সংরক্ষিত এলাকায় অনুমতি ছাড়া প্রবেশ নিষেধ’লেখা সাইনবোর্ড টানিয়ে দেদারছে সেমাই তৈরি করতে শুরু করেছে। অভিযোগ উঠেছে,ঝামেলা এড়াতে পুলিশ প্রশাসনসহ শাসক দলের নেতাকর্মীদের ম্যানেজ করে এসব ব্যবসা পরিচালনা করছে অধিক মুনাফালোভী সংঘবদ্ধ একটি চক্র। মানবদেহের ক্ষতিকারক বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার করে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি করা হচ্ছে ভেজাল সেমাই। অতিথি আপ্যায়নে ব্যবহৃত এসব সেমাই খেয়ে অনেকেই পেটের পীড়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন,অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বিষাক্ত কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি করা এসব ভেজাল সেমাই খাওয়ার পর মানবদেহে টক্সিন ইনবিউজ হেপাটাইটিস বা লিভার সমস্যাসহ বড় ধরণের জটিল রোগ হতে পারে। এছাড়াও একিউট গেস্ট্রো এন্টেরাইটিস বা শরীরে লবনের ঘাটতি হয়ে পানিশূণ্যতা দেখা দিতে পারে। ফলে পেটব্যথা বা বমি হতে পারে। এমনকি দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা না করানোর কারণে মানবদেহে মরণব্যাধি ক্যান্সার বাসা বাধতে পারে। প্রতি রমজান ও ঈদ মৌসুমে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এসব ভেজাল সেমাই উৎপাদন ও বাজারজাত করার অপরাধে বিভিন্ন কারখানায় অভিযান চালিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর ও র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত জেল-জরিমানা করেছেন। এরপরও অসাধু এ চক্রটি থেমে থাকেনি। অধিক মুনাফার আশায় তারা ফের নানা কৌশলে নামি-দামি বিভিন্ন কোম্পানীর মোড়ক-লোগো নকল করে ভেজাল সেমাই উৎপাদন ও বাজারজাত করছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে,নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ এ উল্লেখ রয়েছে, বেকারিপণ্য তৈরির সময় কারখানার ভেতর কর্মরত সকল কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বিশেষ পরিচ্ছন্ন পোশাক ও হাতে গ্লোভস পরা বাধ্যতামূলক। কিন্তু সেমাই উৎপাদন কারখানাগুলোতে এসব নিয়ম মানছে না কেউই। সেমাই প্রস্তুতকারী এক ব্যবসায়ি জানান,ঈদকে টার্গেট করে বাজার ধরতে কয়েকমাস আগ থেকেই সেমাই তৈরির কারখানাগুলো সচল হয়ে উঠে। তখন সরকারি বিধি-বিধান পালন করার মত সময় কারো থাকে না। সংশ্লিষ্ট একাধিক সুত্র জানায়,ময়দার সঙ্গে ৭০ শতাংশ সয়াবিন তেল,৩০ শতাংশ ডালডা দিয়ে সেমাই তৈরির নিয়ম থাকলেও সেমাই উৎপাদনকারীরা তা মানছে না। তারা ডালডার দাম কম থাকায় সয়াবিন তেলের পরিবর্তে সেমাই তৈরির ক্ষেত্রে শতভাগ ডালডা ব্যবহার করছে। শুধু তাই নয়,সেমাই দীর্ঘদিন মচমচে রাখার জন্য মোটরযানে ব্যবহৃত পোড়া মবিলও সেমাইয়ের সাথে মিশিয়ে দিচ্ছে। সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, রাজধানীর ঘণবসতিপূর্ণ কামরাঙ্গীররচরের বিস্তির্ণ জনপদে সেমাই তৈরির প্রায় ২০টি কারখানা রয়েছে। খোদ কামরাঙ্গীরচর থানার পেছনের একটি কারখানায় পুলিশ প্রশাসনের নাকের ডগায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দেদারছে তৈরি করা হচ্ছে ভেজাল ও নকল সেমাই। গতকাল রাতে থানার পেছনে কলেজ রোডে গিয়ে দেখা গেছে একটি কারখানার প্রধান ফটকে তালা ঝুলছে। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে সেমাই তৈরির মেশিনের ঘটঘট শব্দ। স্থানীয়রা জানান,ওই কারখানার মালিক সোনা মিয়া। দিনরাত কারখানার গেটে তালা ঝুলিয়ে ভেতরে সেমাই উৎপাদন করছে শ্রমিকরা। রমজান ও ঈদ সামনে তাই কারখানার ভেতর সেমাই তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন কারখানার মালিক-শ্রমিকরা। সুত্র জানায়, কামরাঙ্গীরচরের হুজুরপাড়ায় আনিসের সেমাই কারাখানা,বেইলী রোডে চৈতালি সেমাই কারখানা,খালপাড় রোডে মুসলিম,মোঃ আলী,নাছির ও পোস্তার রহমানের ভেজাল সেমাই তৈরির কয়েকটি কারখানা রয়েছে। বড়গ্রাম, মাদবরবাজার,পাকাপুল, খোলামোড়াঘাটসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ১০টি ভেজাল ও নকল সেমাই তৈরির কারখানা রয়েছে। গতকাল দিনরাত কয়েক দফা এসব কারখানা ঘুরে মালিকদের কাউকেই পওয়া যায়নি। কারখানার প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে রাখা হলেও ভেতরে সেমাই তৈরির কাজ করছে কয়েকশ’ শ্রমিক। তবে বাইরে থেকে দেখে বোঝার কোন উপায় নেই যে,তালাবদ্ধ এসব কারখানাগুলোতে সেমাই উৎপাদন করা হচ্ছে। ঝামেলা এড়াতে কারখানাগুলোর বাইরে সতর্ক প্রহরায় থাকেন মালিকপক্ষের নিয়োজিত সোর্স। কারখানার সামনে ও আশপাশে পুলিশ প্রশাসন বা অপরিচিত কোন লোক দেখলেই মুঠোফোনে মালিককে জানিয়ে দেয়া হয়। এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা বলেন,জীবিকার তাগিদে তারা এসব কারখানায় সেমাই তৈরির কাজ করেন। যেভাবে সেমাই তৈরি করা হয়,তা নিজের চোখে দেখলে কেউ আর এসব সেমাই খাবে না। তারা আরো বলেন,এসব পত্রিকায় লিখে কোন লাভ হবে না। কারণ,কারখানার মালিকরা থানা পুলিশ,স্থানীয় শাসক দলের নেতাকর্মী এমনকি পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের নিয়মিত মাশোহারা দিয়েই এসব ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। মাঝে মধ্যেই থানার বড়সাহেব ও শাসক দলের নেতারা কারখানায় ঢুকে মালিকদের সাথে আড্ডা দিয়ে বখরা নিয়ে যান। সংশ্লিষ্টরা জানায়,রাজধানীর ডেমরা,যাত্রাবাড়ি,কদমতলী, গেন্ডারিয়া, শ্যামপুর,লালবাগ,চকবাজার,হাজারীবাগ,মোহাম্মদপুর,সুত্রাপুর,সবুজবাগ, খিলক্ষেত,মিরপুর,মুগদা ও রাজধানীর পার্শ্ববর্তী কেরানীগঞ্জ,সাভার-আশুলিয়ায় ভেজাল ও নকল সেমাই তৈরির শতাধিক কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় উৎপাদিত ভেজাল ও নকল সেমাই প্রতিদিন ভ্যান-টালীগাড়ী ছাড়াও ট্রলারযোগে পুরান ঢাকার পাইকারি মার্কেট মৌলভীবাজার ও ছোটকাটারার পাইকারি মার্কেটসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাজারজাত করা হচ্ছে। প্রতিবছরের অন্যান্য দিনে অধিকাংশ কারখানায় সেমাই উৎপাদন ঢিলেঢালা থাকলেও রমজান ও ঈদকে সামনে রেখে অসাধু এসব ব্যবসায়িরা বেপরোয়া হয়ে ভেজাল ও নকল সেমাই তৈরির মহোৎসবে মেতে উঠে। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কয়েক মাস ব্যবসা করেই কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় অধিক মুনাফালোভী সংঘবদ্ধ এসব ব্যবসায়িরা। এদিকে ভেজাল-নকল সেমাই উৎপাদন ও বাজারজাত ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট এলাকার কারখানা ও পাইকারি বাজারে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়মিত নজরদারিসহ অভিযান চালানোর দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
0 Comments