ভেজাল ওষুধের রমরমা বাণিজ্য

কী শহর, কী প্রত্যন্ত গ্রাম সর্বত্রই রোগী আসল ওষুধের মূল্য দিয়ে নকল ওষুধ কিনে প্রতারিত হচ্ছেন। যেন গোটা দেশটাই ভেজাল ওষুধে সয়লাব হয়ে গেছে। ফলে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। বিশেষ অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশের ১৯৩টি কোম্পানির মধ্যে ৫৯টিতেই উৎপাদন করা হচ্ছে ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ।

ভেজাল ওষুধ প্রস্তুতকারীরা বাজারের ভালো ব্র্যান্ডের ওষুধের মোড়ক, প্যাকেট ও বোতল নকল করে ওষুধ তৈরি করছে। আর এর মাধ্যমে বছরে প্রায় আড়াইশ কোটি টাকার নকল ওষুধ বিক্রি করা হচ্ছে। র‌্যাবের ম্যাজিস্ট্রেটরা জানান, ভেজাল ওষুধের মধ্যে আটা, ময়দা, চিনি, বেসন, নিম্নমানের ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রেড (ওষুধের কাঁচামাল) ও পানি মেশানো হচ্ছে।

অন্যদিকে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর পর্যাপ্ত তদারকি ও নজরদারির অভাবে গ্রামগঞ্জ, মফস্বলের ফার্মেসিগুলো এখন ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। রাজধানীর সবচেয়ে বড় ওষুধের মার্কেট মিটফোর্ড থেকেই বেশিরভাগ ভেজাল ওষুধ দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ছে বলে জানা গেছে।

সংসদীয় কমিটির তরফ থেকে ভেজাল ওষুধ তৈরিতে জড়িত কিছু প্রতিষ্ঠানকে এরই মধ্যে সংশোধনের জন্য সময় দেওয়া হলেও তা আমলে না নিয়েই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের আইনি জটিলতার কারণে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর।

অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, কম জনবল দিয়ে ভেজাল ওষুধের আগ্রাসন ঠেকানো সম্ভব নয়। বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের ডেপুটি সেক্রেটারি মো. মনির হোসেন বলেন, মানুষ এখন বেশি টাকা দিয়ে মানহীন ওষুধ খাচ্ছে। রোগীরা মুনাফালোভী বেসরকারি ওষুধ কোম্পানিগুলোর হাতে জিম্মি।

জানা যায়, কেরানীগঞ্জ, কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ, লালবাগ, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, জিঞ্জিরা, মুগদা, বনশ্রী, মিরপুর ও পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় ভেজাল ও নকল ওষুধ তৈরির কারখানার সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব কারখানা থেকে আটক হওয়াদের কারাদন্ড হলেও ছাড়া পেয়ে পুরনো ব্যবসায় ফিরে যান।

ওষুধ মালিক সমিতির মতে, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের গাফিলতির কারণে ভেজাল ওষুধ প্রস্তুতকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। পাইকারি মূল্য কম হওয়ায় কিছু অসাধু খুচরা ব্যবসায়ী নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি করছেন। তারা ডাক্তারের পরামর্শপত্রে যে ওষুধের নাম লেখা থাকে তা না দিয়ে রোগীকে একই ওষুধ বলে নিম্নমানের ওষুধ গছিয়ে দিচ্ছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ ও প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক জানান, ভেজাল ও নকল ওষুধ মূলত বিক্রি করছে অনুমোদনহীন কিছু কোম্পানি। এর সঙ্গে যে ওষুধগুলোর বিক্রি বেশি অসাধু ব্যবসায়ীরা সে ওষুধের প্রয়োজনীয় ও নির্দিষ্ট কাঁচামালের পরিবর্তে নিম্নমানের পদার্থ মিশিয়ে আসল ওষুধের প্যাকেট বা নাম দিয়ে নকল ওষুধ তৈরি করছেন।

এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা মুনাফালোভী চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগসাজশ করে এ ধরনের অপকর্ম করছেন। জানা যায়, ভেজাল ও নকল ওষুধের মধ্যে বাজারে ভালো চাহিদা রয়েছে এমন ধরনের বিভিন্ন প্রকার অ্যান্টিবায়োটিক, হরমোন ও অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের পরিমাণ বেশি। এদিকে নকল ও ভেজাল ওষুধে বাজার সয়লাব হওয়ায় রোগীদের স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি আসল ওষুধের দামে নকল ওষুধ কিনে প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে।

বিক্রি হওয়া ইনজেকশনের মধ্যে নকল হচ্ছে হাইড্রোকরটসিন, মিথাইল প্রডেনিসোল গ্রুপের ইনজেকশন। ময়দা দিয়ে নকল হচ্ছে য²ায় ব্যবহৃত রিফিমপিসিন ট্যাবলেট। কিডনি ও ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ইপরেক্স ইনজেকশনেরও ভেজাল তৈরি হচ্ছে। দেশে সোয়া দুই লাখের বেশি ওষুধের দোকান থাকলেও রেজিস্টার্ড ৬০ হাজার দোকানে বিক্রি হচ্ছে ভেজাল ও নকল ওষুধ।

র‌্যাবের অভিযানে মিটফোর্ড-বাবুবাজারে আইসিডিডিআরবির নকল রাইস স্যালাইন তৈরির কারখানার সন্ধান পাওয়া যায়। এখানে অসাধুচক্র ফার্মা গ্রেড কাঁচামালের পরিবর্তে ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রেড কাঁচামাল ব্যবহার করত। সাধারণত নিচুমানের ওষুধের মূল্য ভালো ব্র্যান্ডের ওষুধের মূল্যের প্রায় সমান। কিন্তু বাজারে চালানোর জন্য পাইকারি মূল্য কম ধরা হয়। যেমন আসল গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ অমিপ্রাজলের মূল্য ৪০০ টাকার বেশি হলেও নকল অমিপ্রাজলের পাইকারি মূল্য ৭০ টাকার বেশি। ব্যথার ওষুধ ডাইক্লোফেনাক ১০০ টাকা হলেও নকল ওষুধের দাম ১৭ টাকা।

এ ছাড়া নকল ওষুধের মধ্যে আরও তৈরি হচ্ছে হরমোলিড বায়োজেন, রেনিটিডিন, মাই গ্লোড, সাসটন নামের বিভিন্ন ওষুধ। এসব কারখানায় কোনো দক্ষ ক্যামিস্ট বা ফার্মাসিস্ট দ্বারা ওষুধ তৈরি হয় না। বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতি সূত্র জানায়, ভেজাল ওষুধের মধ্যে আটা, ময়দা, চিনি, বেসন, পানি মিশিয়ে ট্যাবলেট ও ক্যাপসুল তৈরি হয়। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, নকল বা ভেজাল ওষুধ সেবনে যেমন রোগের প্রতিকার হয় না, তেমনি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ারও আশঙ্কা থাকে।

এদিকে ভেজাল, নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধে সয়লাব হয়ে গেছে গ্রামগঞ্জসহ মফস্বলের বাজার। এর মূল কারণ পর্যাপ্ত তদারকি ও নজরদারি নেই। ভেজাল ওষুধ তৈরিকারী সংঘবদ্ধ চক্র এ ভেজাল ওষুধগুলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ অবস্থায় প্রয়োজন একটি যুগোপযোগী ওষুধনীতি।

জানা যায়, সরকারি হাসপাতালগুলোয় বিনামূল্যের ওষুধ বিক্রি হচ্ছে খোলাবাজারে। ঢাকাসহ সারা দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোর কর্মচারীরা হাসপাতালের ওষুধ ফার্মেসিতে নিয়ে বিক্রি করে দিচ্ছেন এমন অভিযোগ বেশ পুরনো। অনেক সময় মফস্বলের ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ সরকারি ওষুধও বিক্রি হতে দেখা যায়। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে নকল ওষুধ তৈরির প্রবণতা আরও বাড়তে পারে।

0 Comments

There are no comments yet

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

4 × 3 =

Back to top