মাছে ভেজাল মিশিয়ে দেশের সর্বনাশ করবেন না

মাছে ভেজাল মিশিয়ে দেশের সর্বনাশ করবেন না

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সামান্য মুনাফার লোভে মাছে ভেজাল মিশিয়ে নিজের ও দেশের ক্ষতি না করতে মৎস্য ব্যবসায়ী, উৎপাদক ও রফতানিকারকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, আমাদের এখানে মুনাফার লোভে কিছু কিছু মানুষের ভেজাল দেয়ার একটা প্রবণতা আছে। এই ভেজাল দিয়ে বেশি মুনাফা করতে গিয়ে একেবারে নিজের ব্যবসার সর্বনাশ, দেশেরও সর্বনাশ। এই সর্বনাশের পথে কেউ যাতে না যায়।

দেশের মৎস্য সম্পদের বিপুল সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি সবাইকে অনুরোধ করব- সামান্য একটু মুনাফার লোভে নিজের ব্যবসাটা নষ্ট করবেন না, আর দেশের রফতানি বা দেশের পণ্যটাও নষ্ট করবেন না। রফতানির সময় ‘কোনমতেই কোনরকম’ অভিযোগ যেন না আসে সে বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। সেই সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার ক্রমশ বড় হওয়ায় সেই চাহিদা মেটাতেও ভেজালের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

বুধবার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ‘জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ- ২০১৭’ উপলক্ষে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এ আহ্বান জানান। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী ছায়েদুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ এবং মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহমুদুল হাসান খান বক্তৃতা করেন।

প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে ১৩ মৎস্যচাষী এবং প্রতিষ্ঠানকে মৎস্য খাতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেব স্বর্ণ ও রৌপ্য পদক প্রদান করেন। এদের মধ্যে ৪ জন স্বর্ণ এবং ৯ জন রৌপ্য পদক লাভ করেন। পদক ও সনদপত্রসহ নগদ ৫০ হাজার এবং ৩০ হাজার টাকার চেকও বিজয়ীদের প্রদান করেন প্রধানমন্ত্রী। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর গণভবনের লেকে প্রধানমন্ত্রী মাছের পোনা অবমুক্ত করেন। ১৮ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত এবারের মৎস্য সপ্তাহ উদযাপিত হচ্ছে। মৎস্য সপ্তাহের এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- ‘মাছ চাষে গড়ব দেশ, বদলে দেব বাংলাদেশ।’

প্রধানমন্ত্রী সামান্য মুনাফার লোভে মাছে ভেজাল মিশ্রণের অতীত অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে আরও বলেন, আমাদের বিচিত্র একটা অভিজ্ঞতা আছে। ১৯৯৬ সালে যখন ক্ষমতায় আসি, তখন দেখলাম চিংড়ি রফতানি বন্ধ হয়ে গেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশ থেকে চিংড়ি নেবে না। কারণ জানতে গিয়ে শুনলাম চিংড়ি মাছের ভেতর লোহা ঢুকিয়ে দিয়ে ওজন বৃদ্ধি করে সেটা রফতানি করতে গেছে এবং এটা তখনই ধরা পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু রফতানি বন্ধ। তিনি বলেন, সবে সরকারে এলেও দ্রুত ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে ফের রফতানি শুরুর ব্যবস্থা করি। আমরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে কথা বলে মৎস্য খাতের উন্নয়নের জন্য সেই সময় ৪০ কোটি টাকা এবং একটি কমিটি করে দেই। সেই টাকা দিয়ে প্রত্যেকটি হ্যাচারি উন্নত করা হয়। ধীরে ধীরে মানসম্পন্ন রফতানির মধ্যদিয়ে আবার মৎস্য রফতানি সচল হয়।

মাছে ফরমালিন ব্যবহারের বিরুদ্ধে তার সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, এক সময় ফরমালিন সম্পর্কে সবাই খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন। আমরা কিন্তু ইতোমধ্যে ফরমালিনের অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করেছি। ফরমালিন যাতে ব্যবহার না হয়, তার ব্যবস্থা নিচ্ছি। তিনি বলেন, সরকার প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দিয়ে গবেষণা উৎসাহিত করায় দেশে বিভিন্ন জাতের মাছের চাষ ও উৎপাদন বাড়ছে। বর্তমানে বছরে প্রায় ৪০ লাখ মেট্রিক টন মাছ দেশে উৎপাদন হচ্ছে; এক কোটি ৮২ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা এখন মৎস্য সম্পদের সঙ্গে সম্পর্কিত। জিডিপিতে মৎস্যসম্পদের অবদান প্রায় ৪ শতাংশ। আর আমাদের দেশে প্রাণিজ আমিষের ৬০ ভাগের যোগান আসে মৎস্য খাত থেকে। মিঠা পানির মৎস্য আহরণে বাংলাদেশের অবস্থা বিশ্বে চতুর্থ।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে আন্তর্জতিকভাবে পুরস্কৃত হয়। বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল পাঁচ বছরই বাংলাদেশ দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। আন্তর্জাতিকভাবে তারা বাংলাদেশের জন্য তিরস্কার আনে। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে পুরস্কৃত হয়। মৎস্য উৎপাদন ও মৎস্য সম্প্রসারণ কার্যক্রম বাস্তবায়নে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা মৎস্য অধিদফতরকে এ্যাডওয়ার্ড ট্রমা পুরস্কারে ভূষিত করে। বৈশাখে ইলিশ খাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বৈশাখ মাসে ইলিশ খাওয়ার ধুম পড়েছিল। কোন যুক্তি নেই। আমি আহ্বান করেছি, পহেলা বৈশাখে ইলিশ মাছ খেতে হবে এরকম কোন কথা নেই। এ সকল পদক্ষেপের সুফল আমরা পাচ্ছি। আমি বৈশাখে ইলিশ মাছ খাই না, খাব না। বর্তমানে দেশের মাছের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ছে। আগে একজন রিক্সাওয়ালা যেখানে শুধু চাল কিনতে সক্ষম ছিল, সে এখন একটু মাছও সঙ্গে কিনতে পারেন। একজন দিন মজুরের সক্ষমতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এজন্য চাহিদাও বাড়বে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা যত বাড়বে, আমাদের বাজারও ততটা বৃদ্ধি পেতে থাকবে। তিনি বলেন, আমি প্রথমবার ক্ষমতায় এসেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনুরোধ করেছিলাম যেমন আমাদের কৈ মাছ, মাগুর মাছসহ দেশী মাছের ওপর গবেষণার জন্য। আগে দেখতাম তেলাপিয়া ও কার্প জাতীয় মাছ নিয়েই কেবল গবেষণা চলত। কোন মাছটার বাজারে চাহিদাটা বেশি সেটা নিয়েই আমাদের গবেষণা করা, উৎপাদন বৃদ্ধি করা এবং প্রক্রিয়াজাত করে সেটা বিদেশে রফতানি করা প্রয়োজন।

হাওড়াঞ্চলে মাছ চাষ বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বন্যার কারণে সেখানে প্রায়ই ফসল নষ্ট হয়। এ কারণে সেখানে মাছ চাষে বেশি জোর দিতে হবে। হাওড়ের ভেতরে খালগুলো ড্রেজিং করতে হবে। কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও সিলেট বিভাগের হাওড়গুলোর পাশাপাশি উত্তরবঙ্গের বিল ও জলাশয়গুলোতে মাছ উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে রফতানি বাড়াতে হবে। এ জন্য সাভার, চট্টগ্রাম ও খুলনায় তিনটি আধুনিক মাননিয়ন্ত্রণ ল্যাব স্থাপন করার কথা জানিয়ে তিনি সিলেট ও উত্তরবঙ্গে আরও দুটি ল্যাব স্থাপনের প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করেন।

প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধী নিষ্পত্তির ফলে বিশাল সমুদ্র এলাকা থেকে সম্পদ আরোহণের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যে তার সরকার একটি জাহাজ কিনেছে; আরও একটি জাহাজ কেনা হচ্ছে। তিনি বলেন, আসলে বাংলাদেশের মাটি সোনার মাটি। যা কিছু আমরা চেষ্টা করলেই কিন্তু উৎপাদন করতে পারি। তাই কোনটার বাজার চাহিদা বেশি, সেটার ওপর নির্ভর করে গবেষণা করা, উৎপাদন বৃদ্ধি করা এবং প্রক্রিয়াজাত করে রফতানি করা- এদিকেই বেশি নজর দিতে হবে।

তিনি বলেন, তার সরকার মুক্ত জলাশয়ে পোনা অবমুক্ত করা, জলমহালে সমাজভিত্তিক মাছ চাষ ব্যবস্থাপনা, মৎস্য আবাসস্থল উন্নয়ন, প্লাবনভূমিতে মৎস্যচাষ ও অভয়াশ্রম স্থাপনসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের ব্যবস্থা, জলমহালগুলোতে প্রকৃত জেলেদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য নতুন জলমহাল নীতিমালা করায় দেশে মাছ উৎপাদন বেড়েছে। সেই সঙ্গে মানসম্পন্ন চিংড়ি সরবরাহ নিশ্চিতের লক্ষ্যে জাতীয় চিংড়ি, নীতিমালা উন্নয়ন, মা ইলিশ রক্ষা ও জাটকা নিধন রোধে কার্যকর কর্মসূচী বাস্তবায়নের কথাও বলেন প্রধানমন্ত্রী।

দেশের মৎস্যসম্পদ রক্ষা ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জলমহালে সমাজভিত্তিক মাছ চাষ ব্যবস্থাপনা, মৎস্য আবাসস্থল উন্নয়ন, প্লাবনভূমিতে মৎস্যচাষ ও অভয়াশ্রম স্থাপনসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ এবং অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয়ে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্দেশে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, গুণগত মানসম্পন্ন মাছের পোনা উৎপাদনের জন্যও যুগোপযোগী কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। সেইসঙ্গে দেশী-বিদেশী ভোক্তাদের মানসম্পন্ন চিংড়ি সরবরাহ নিশ্চিতের লক্ষ্যে জাতীয় চিংড়ি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত জেলেদের সহায়তা কর্মসূচীতে খাদ্যশস্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১ লাখ ৯৬ হাজার ৫৬৯ মেট্রিক টন যা ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ছিল মাত্র ৬ হাজার ৯০৬ মেট্রিক টন। এর ফলে ইলিশ উৎপাদন প্রায় ১ লাখ মেট্রিক টন বৃদ্ধি পেয়ে ৩ লাখ ৮৭ হাজার মেট্রিক টনে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, এ ধরনের বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ ও কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা মাছের উৎপাদন ও আহরণ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩৮ লাখ ৭৮ হাজার মেট্রিক টন মৎস্য টন মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে যা ইতোপূর্বে ছিল ৯ লাখ ৭৪ হাজার মেট্রিক টন। ফলে অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে মৎস্য আহরণে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ স্থান অধিকার করার গৌরব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। তিনি বলেন, বিপন্নপ্রায় মৎস্য প্রজাতির সংরক্ষণ, প্রজনন ও বংশ বিস্তারের জন্য মুক্ত জলাশয়ে অভয়াশ্রম স্থাপন ও এর সংরক্ষণে দেশের মৎস্য খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলে আরও তৎপর হবেন।

0 Comments

There are no comments yet

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

12 + seven =

Back to top