ভেজাল ইলিশ রাজধানীর অলিগলিতে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে

ভেজাল ইলিশ রাজধানীর অলিগলিতে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে 
 

ঢাকা, ০১ নভেম্বর- ভরা মৌসুম চলছে ইলিশের। প্রচুর ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে দেশের অন্যান্য স্থানের মত রাজধানীর কারওয়ান বাজার বা যাত্রাবাড়ির আড়তে। বছরের অন্য সময়ের চেয়ে দামও কিছুটা সহনশীল। পাশাপাশি সব মাছের দামও কমছে ইলিশের প্রভাবেই বাজারে। একদিকে বাজারে ইলিশের সরবরাহ বেড়েছে অন্যদিকে দামেও সাশ্রয়, এতে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই ‘খুশি’।

কিন্তু বাজারে এখন ইলিশের পরিমাণ বেশি হলেও রাজধানীর অলিগলিতে ইলিশ পরিচয়ে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে ‘চন্দনা’, ‘সার্ডিন’ ও ‘চৌক্কা’। এসব মাছের সাইজ অনুযায়ী রয়েছে দামেরও ভিন্নতা রয়েছে। এগুলো আসল ইলিশ ভেবে কিনে প্রতিদিনই প্রতারিত হচ্ছেন সাধারণ ক্রেতারা। পাশাপাশি তারা আসল ইলিশের স্বাদ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন।

সাধারণত সবার কাছেই আকর্ষণীয় পদ্মার ইলিশ। সরেজমিনে জানা গেছে, রোজ সন্ধ্যার পরই রাজধানীর বিভিন্ন অলিগলিতে কিছু ব্যবসায়ী ‘চন্দনা’, ‘সার্ডিন’ ও ‘চৌক্কা’ মাছ ইলিশ বলে বিক্রি করছেন। এসব মাছ স্বাদে-গন্ধে ইলিশের ধারের কাছেও নেই। কিন্তু ক্রেতাদের কেউ না চিনে কেউ বা কম দামে পেয়ে এগুলো লুফে নিচ্ছেন। এভাবে সাগরের কিংবা নদীর ইলিশ বলে ক্রেতাদের ঠকাচ্ছেন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী।

মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, ক্রেতার কাছে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় পদ্মার ইলিশ। নদীর ইলিশের স্বাদ সাগরের ইলিশের তুলনায় বেশি। তাই এই ইলিশই বেশি পছন্দ সবার। এদিকে জাটকা ছাড়াও ইলিশের মতো দেখতে চন্দনা, চাপিলা, সার্ডিন ও চৌক্কা পাওয়া যায় বাজারে। ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত ছোট ইলিশকে সরকার জাটকা ঘোষণা করেছে। সার্ডিনকে টাকিয়া আর চৌক্কাকে চৌক্কা ফ্যাঁইসা বা চটপটিও বলা হয়। একটি পরিপূর্ণ ইলিশ লম্বায় ৫০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। স্বাদে এসব মাছ ইলিশের ধারেকাছেও নেই।

ক্রেতারা বলছেন, ভরা মৌসুম হওয়ায় স্বস্তায় ইলিশ পাচ্ছেন। তাই কিনেও নিচ্ছেন। কিন্তু এগুলো প্রকৃত ইলিশ নয়, সেটি অনেকের অজানাই রয়ে গেছে। অন্যদিকে অসাধু ব্যবসায়ীরা মুনাফার লোভে জেনেবুঝেই এসব মাছ বাজারে ছেড়ে দিচ্ছেন। বাজার সয়লাভ হয়ে পড়ছে ভেজাল ইলিশে।

ইলিশ বলে যা বিক্রি হচ্ছে
সার্ডিন:
সার্ডিন মাছ অনেকটা জাটকার মতো দেখতে। এগুলো আকারে ছোট হয়, চোখের আকার বড়। এটির মাথা বড় এবং সামনের অংশ ভোঁতা থাকে। বাজারে জাটকা বা ছোট ইলিশ হিসাবে এগুলো বিক্রি হচ্ছে। সার্ডিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকাভেদে ২ হালির দাম ৫০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত। প্রতিটির ওজন সাড়ে তিনশ’ থেকে চারশ’ গ্রাম। মাছগুলো জাটকার মতো দেখতে হলেও স্বাদে-গন্ধে ইলিশের ধারের কাছেও নেই। বিক্রেতারা বলছেন, ডিম ছাড়ার কারণে মাছগুলো চিকন হয়ে গেছে।

চৌক্কা: চৌক্কা মাছিটি বেশ লম্বা আকারের হয়। লম্বায় এরা ইলিশের সমান। চৌক্কার মাথা লম্বাটে ও সুচালো আর চোখের আকার বড়। তবে ইলিশের চেয়ে কম চওড়ার আর পাতলা হয় মাছগুলো। রাজধানীর বেশির ভাগ বাজারেই এটি পাওয়া যায়। সাধারণ ক্রেতারা সবচেয়ে বেশি প্রতারিত হন এই মাছটি কিনে। ফেরি করে বিক্রির পাশাপাশি এটি অভিজাত বাজারেরও পাওয়া যায়।

এটি বিক্রি হয় হালি হিসাবে আবার কেজি হিসাবেও। প্রতি কেজি ইলিশের দাম হাঁকা হয় ৫০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত। আর হালি হিসাবে ‘প্রতি হালি’ বিক্রি হয় ৮০০ থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত। সাধারণত বিক্রেতারা থালা নিয়ে বাসাবাড়ির সামনে ফেরি করে এসব বিক্রি করছেন।

চন্দনা: রাজধানীর বাজারে এ মাছটি না পাওয়া গেলেও সন্ধ্যার পর থেকেই বিভিন্ন অলি-গলি কিংবা রাস্তার পাশে বসে ফেরিওয়ালারা বিক্রি করে। এ মাছটিরও চোখ বড় আকারের হয়। মাছটি আকারে প্রায় ইলিশের সমান হলেও ওজনে হালকা আর পেটের দিকটা চ্যাপ্টা আকারের হয়। এটি হালি হিসাবে বিক্রি হয়। এ মাছটি প্রতি হালি বিক্রি হয় ৫০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত। এ মাছগুলো বেশির ভাগই রাজধানীর যাত্রাবাড়ি বাজার থেকে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে।

এ বিষয়ে চোক্কা মাছ বিক্রেতা আমজাদ হোসেন বলেন, এগুলোও ইলিশ মাছ। তবে ডিম ছেড়ে দেওয়ায় মাছগুলোর আকারের পরিবর্তন হয়, পাতলা হয়ে যায়। কিভাবে কম দামে ইলিশ (চৌক্কা)বিক্রি করছেন জানতে চাইলে বলেন, না এগুলো বাজারে বেশি আসলে আমরা কম দামে পাই। ওই সময় বেশি করে কিনে রাখি পরে ধীরে ধীরে তা বিক্রি করি।

ইদ্রিস আলী নামের অপর মাছ বিক্রেতার দাবি, মাছগুলো সাগরের ইলিশ। সাগরে বেশি মাছ পাওয়া যায় তাই দামও কম থাকে। আমরা বিকালের দিকে যাত্রাবাড়ি থেকে কিনে সন্ধায় ফেরি করে বিক্রি করি। দাম কম হওয়ায় এগুলো চাহিদাও বেশি থাকে। কিছুক্ষণ জেরার পর অবশেষে এ প্রতিবেদকের কাছে সত্য স্বীকার করেন ইদ্রিস। বলেন, এগুলো আসলে ইলিশ মাছ না, তবে ইলিশ মাছের মতো।

কারওয়ান বাজারের মাছ বিক্রেতা আহম্মেদ হোসেন বলেন, রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে এসব মাছ বিক্রি হয় এটা আমিও দেখেছি। তবে এ মাছগুলো কারওয়ান বাজারে আসলে বিক্রি হবে না। আসল ইলিশের পিট মোটা আকারের হয়, ওজন ভাল থাকে, দামও বেশি। আর সার্ডিন বা চৌক্কা ইলিশ মাছ না। তবে সাধারণ ক্রেতারা এটা চিনতে পারেন না অনেক সময়, এ জন্য প্রতারিত হয়। তবে চন্দনা, সার্ডিন ও চৌক্কার গন্ধ ইলিশের মতো নয়। তিনি বলেন, এ মাছগুলো সব চেয়ে বেশি বাজারে আসে ১ বৈশাখকে সামনে রেখে।

এদিকে আজ বুধবার কারওয়ান বাজারের পাইকারি মাছ বাজারে প্রতি ৭০০ থেকে ৭৫০ গ্রাম ওজনের ইলিশের হালি ১৫শ’ থেকে ১৬শ’ টাকা। ৮০০ গ্রামের ওপরে হলে প্রতি হালির দাম পড়বে ২৪০০ টাকা। আর ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের কেজি ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা, ৪০০ গ্রামের ইলিশের কেজি ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

শফিফুল ইসলাম নামে এক ক্রেতা বলেন, নদীতে ইলিশ বেশি ধরা পরায় বাজারে সরবারহ ভালো। আর এটি আমার পছন্দের মাছ। এসব ইলিশের দামও কম হলেও বড় ইলিশের দাম কমেনি।

এদিকে সোমবার অন্যান্য মাছের মধ্যে প্রতি কেজি রুই ও কাতলা ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা, পাঙ্গাস ১২০ থেকে ২০০ টাকা, টেংরা ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা, সরপুঁটি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা, তেলাপিয়া ১২০ থেকে ১৬০ টাকা, সিলভার কার্প ১২০ থেকে ২৫০ টাকা, চাষের কৈ ১৬০ থেকে ২২০ টাকা, মাগুর ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

উল্লেখ্য, ইলিশ সম্পদ সংরক্ষণে প্রধান প্রজনন মৌসুম হিসেবে গত ১ থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত (২২ দিন) ইলিশ ধরা, বিক্রি, পরিবহন, মজুদ, বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করেছিল সরকার।

0 Comments

There are no comments yet

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

3 × 5 =

Back to top