পথে-ঘাটে অস্বাস্থ্যকর খাবার 

পথ-ঘাট, বাজার, লঞ্চ, ফেরি-নৌকাঘাট, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন, সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত চত্বর এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে রং-বেরংয়ের খাবার অবাধে বিক্রি হচ্ছে। এসব খাবার কতটা অস্বাস্থ্যকর তা বোঝেও বোঝে না অনেকে। ইচ্ছা-অনিচ্ছায় বা বাধ্য হয়ে আদরের শিশুসন্তানদের কিনে দিতে হচ্ছে সেসব খাবার। ক্ষুধা নিবারণের জন্য কখনও নিজেরাও কিনে খাচ্ছি। দৈনন্দিন প্রয়োজনে বাড়িতেও আনতে হচ্ছে ভেজাল দ্রব্য।
প্রতিনিয়ত প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হচ্ছে মানুষ; অফিস-আদালত, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজে যাচ্ছে। বেঁচে থাকার তাগিদে ঘরে বসে সময় কাটানোর সময় নেই কারও। কর্মের প্রয়োজনেই বাধ্য হয়ে বাইরের খাবার খেতে হচ্ছে অনেকের। দৈনিক ও মাসিক আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে খেতে হচ্ছে ফুটপাত থেকে দামি হোটেলে। আচর্য ব্যাপার হল, উচ্চপর্যায় থেকে নিম্ন শ্রেণির রেস্টুরেন্ট, কনফেকশনারিতে ভেজাল খাবারের ছড়াছড়ি। তাহলে খাবারের নামে আমরা প্রতিনিয়ত কী খাচ্ছি।
সাধারণ মানুষের সমাগম যেখানে, বিশেষ করে শিশুদের স্কুলের সামনে রং-বেরংয়ের খাবার নিয়ে হাজির হয় হকার। শিশুরা মুখরোচক খাবার হওয়ার কারণে ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে ইচ্ছেমতো খায়। বড়রাও ক্ষুধা কিছুটা নিবারণের জন্য বাইরের অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে থাকেন। সময়-অসময়ে মা-বাবার কাছে বায়না ধরে শিশুরা। এদিকে রং-বেরংয়ের খাবার খাওয়ার কারণে বাড়ির তৈরি ভাত ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খেতে অনীহা প্রকাশ করে শিশুরা। খাবারের প্রতি অনীহা থাকার কারণে মায়েরাও দুচিন্তায় পড়েন।
একটি দৈনিক জাতীয় পত্রিকা থেকে জানা যায়, স্যানিটারি পরিদর্শকরা ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকায় খাদ্যপণ্যের নমুনা সংগ্রহ করেন। এসব নমুনা জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধীন পাবলিক হেলথ ল্যাবরেটরিতে পাঠান। সরকারি প্রতিষ্ঠানটি ৪৩টি খাদ্যপণ্যের মোট ৫ হাজার ৩৯৬টি নমুনা পরীক্ষা করে। যায় মধ্যে ২ হাজার ১৪৭টি নমুনাতেই মাত্রাতিরিক্ত ও ভয়াবহ ভেজালের উপস্থিতি ধরা পড়ে। ভেজালের গড়হার ৪০ শতাংশ।
পরীক্ষায় দেখা গেছে, ৪৩টি পণ্যের মধ্যে ১৩টিতে প্রায় শতভাগ ভেজাল পাওয়া গেছে। ভেজালযুক্ত এসব খাদ্যপণ্য হচ্ছে মধু, মিষ্টি, ঘি, রসগোল্লা, দই, সেমাই ও ছানা, ছানার মিষ্টি, চমচম, চাটনি, জুস, লজেন্স ইত্যাদি।
সয়াবিন তেলে ভেজালের হার ৭৮, সরিষার তেলে ৫৬, পামঅয়েলে ৩২, নারিকেল তেলে ২৫ শতাংশ। জিরার গুঁড়ায় ১৮, মরিচের গুঁড়ায় ৬০, হলুদ গুঁড়ায় ৩১ এবং ধনিয়ার গুঁড়ায় ভেজালের মাত্রা ৫৩ শতাংশ। আটা ও আটাজাত দ্রব্যের মধ্যে আটায় ১১, ময়দায় ৯, সুজিতে ২৭, বিস্কুটে ৪৬, বেসনে ৫২ এবং সেমাইয়ে ৮২ শতাংশ ভেজালের উপস্থিতি পাওয়া যায়। মুগ ডালে ৯, চিনিতে ৫, লবণে ৩৬, চা পাতায় ১০, আখের গুড়ে ৫৭, খেজুরের গুড়ে ২৫, চাটনিতে ৮৩ এবং কেকে ৭০ শতাংশ ভেজাল চিহ্নিত করা হয়েছে।
এর বাইরেও হকাররা বাড়িতে আইসক্রিম, চকলেট, চাটনি, শরবত তৈরি করে স্কুল-কলেজ এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবাধে বিক্রি করছে। যা খেয়ে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে অনেকে। শিশু ও গর্ভবতী মায়েরা এতে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি।
ব্যস্ততম শহরে কর্মস্থান থেকে দুপুরের খাবার বাসায় এসে খাওয়া কষ্টকর। কারণ যানজটের শহরে কর্মের বেশি সময় অপচয় হয়ে যায় রাস্তায়। যে কারণে বাধ্য হয়ে ফুটপাত, ভাসমান হোটেল ও কনফেকশনারির ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। এদিকে  ফুটপাত ও ছোট হোটেলগুলোতে দেখা যায়, পুরি, শিঙ্গাড়া, সমুচা, পরোটা, মোগলাই তৈরির জন্য ব্যবহারকৃত সয়াবিন, পামঅয়েল ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে কবে নাগাদ সেই তেল জ্বালানো হয়েছে দোকান মালিক নিজেই বলতে পারবে না। কারণ প্রতিদিনের জ্বালানো তেল রেখে দেওয়া হয়। সেই তেলে নতুন কিছু তেল দিয়ে আবারও জ্বালানো শুরু হয়।
ভেজাল এবং মাংসের তেল ভাজা-পোড়ার কাজে ব্যবহার করে। আবার দোকানের সামনে খোলা জায়গায় রেখে দেওয়া হয়। এ কারণে ধুলাবালি খাবারের সঙ্গে মিশে যায়। ভেজাল তেল দিয়ে তৈরি এবং ধুলাবালি মেশানো খাবার যেন নিত্যদিনের খাবার। বাজারের ভেজাল খাবার খেতে খেতে ভালোটাই ভেজাল মনে হচ্ছে।
স্বার্থান্বেষী মহল অতিরিক্ত মুনাফা লাভের কারণে মানুষকে খাবারের নামে অখাদ্য খাওয়াচ্ছে। এই মহলটি বুঝতে পারে না বাড়িতে তাদের আদরের শিশুসন্তানও খাবারের নামে ভেজাল খাবার খেয়ে বড় হচ্ছে। অর্থের লোভে অন্যকে ঠকাতে গিয়ে নিজেও ঠকে যাচ্ছে মনের অজান্তে। ভেজাল খাবার থেকে সমাজকে মুক্ত থাকতে হলে অবশ্যই আমাদের সচেতন হতে হবে। আসুন, আমরা সবাই মিলে ভেজাল প্রতিরোধ করি।

0 Comments

There are no comments yet

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

3 × one =

Back to top