৪২ হাজার মুক্তিযোদ্ধার সনদ যাচাই প্রসঙ্গে

জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) সুপারিশ ছাড়া যাদের নাম বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ‘বেসামরিক গেজেটে’ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তাদের সনদ যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। ২০০২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪২ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম জামুকার সুপারিশ ছাড়া গেজেটভুক্ত হয়েছে। ২০০২ সালে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ কাউন্সিল আইনের শর্ত মতে, ‘প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন, সনদ ও প্রত্যয়নপত্র প্রদানে এবং জাল ও ভুয়া সনদ, প্রত্যয়নপত্র বাতিলের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ পাঠাবে জামুকা।’ কিন্তু জামুকার সুপারিশ ছাড়া গেজেটভুক্ত হওয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা তো কোনো মতে দায়ী নন। এ ভুল সংশোধনের দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের। এখন করোনার এ দ্বিতীয় ধাপে যাচাই-বাছাইয়ের নামে উপজেলা, নগর পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা ও মৃতদের স্বজনদের ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। তাই সংশ্লিষ্টদের ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত না হয়ে বিকল্প উপায় চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন।
প্রায় পাঁচ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছিলেন, ‘২০১৫ সালের ২৬ মার্চের আগেই মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয়পত্র ও আধুনিক প্রযুক্তির সার্টিফিকেট দেয়া হবে।’ কিন্তু তা আজো বাস্তবায়িত হয়নি।

এদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ১৯৭২ থেকে ২০২০ পর্যন্ত প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় ৫০ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে। ১৯৭১ সালে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের ছাত্রাবস্থায় বা ওই বয়সের কৃষক, শ্রমিক যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন তারাই এখন ৬৫ ও এর ঊর্ধ্বের বয়সে পৌঁছে বেঁচে আছেন। তাদের সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি হওয়ার কথা নয়।

স্বাধীনতার বর্ষপূর্তিতে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক সাক্ষাৎকারে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা সম্পর্কে বলেছেন, ‘নিয়মিত, অনিয়মিত, আনসার, পুলিশ, তরুণ, যুবক মিলিয়ে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১ হাজার’ (সূত্র : ‘তাজউদ্দীন আহমদ : ইতিহাসের পাতা থেকে’ সিমিন হোসেন রিমি সম্পাদিত, প্রতিভাস প্রকাশনা, পৃষ্ঠা-২৯২)।

মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত উপদেষ্টা কমিটির ৯ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সভায় জেনারেল ওসমানী আমন্ত্রণ পেয়ে উপস্থিত ছিলেন। মণি সিংহ তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনার মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের সংখ্যা কত? উত্তরে জেনারেল ওসমানী বলেছিলেন, আশি হাজার’ (সূত্র : মণি সিংহের ‘জীবন সংগ্রাম’ মফিদুল হক, মণি সিংহ স্মারকগ্রন্থ, পৃষ্ঠা-১৫৭)।

প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা স্বাধীনতার পর পর করা হয়নি। প্রাথমিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ প্রদানকালে সতর্কতা অবলম্বন না করায় শুরুতেই বহু ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সরকারি চাকরিসহ নানা সুযোগ-সুবিধা নেন। যার প্রমাণ পাওয়া যায় বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. বি. করিমের বক্তব্যে। ‘যে কথা বলা হয়নি’ নামক স্মৃতিকথায় তিনি লিখেছেন, “সরকারের পূর্ব নির্দেশানুযায়ী আমি ভাইবা বা মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে তিনশত পঞ্চাশজন মুক্তিযোদ্ধাকে চাকরির জন্য সুপারিশ করি। এ ছাড়াও প্রায় দুইশত মুক্তিযোদ্ধার মৌখিক ও লিখিত পরীক্ষা নিয়ে চাকরির জন্য সুপারিশ করি। প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে, মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশ আমাকে এ মর্মে হুমকি দেয় যে, এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা নামধারী অসংখ্য মিথ্যা সার্টিফিকেটধারী যুবক চাকরিপ্রাপ্তির চেষ্টা চালাচ্ছে। যদি এরা চাকরি পেয়ে যায় তাহলে আমার জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে আমি সরকারকে পরামর্শ দেই যে, ‘অবিলম্বে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি ও জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে একটি মুদ্রিত গেজেট করা হোক।’ এতে একদিকে নকল মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরিতে অনুপ্রবেশের সুযোগ বন্ধ হবে, অন্যদিকে আমাদের কাজও নিরাপদ ও নির্ভেজাল হবে। কিন্তু সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত ও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের কাজ এত বিপুল ও সীমাহীন ছিল যে, সরকারের পক্ষে গেজেট তৈরি করার মতো জটিল কাজে হাত দেয়া এত দ্রুত সম্ভব ছিল না। ফলে আমাকে সব সময় ঝুঁকি নিয়েই বিশেষ সতর্কতা ও শান্তরূপে কাজ চালিয়ে যেতে হতো। এভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির বিশেষ কাজটি সম্পন্ন হয়।” (সূত্র : ঐ, সাস পাবলিকেশন্স, পৃষ্ঠা ৪২-৪৩)।

১৯৭২ সালে মুন্সীগঞ্জ মহকুমা সদর থেকে আমার ইউনিটের মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ ও টাকা সংগ্রহকালে আমি দেখেছি যে, মুন্সীগঞ্জ সদরের জনৈক মুক্তিযোদ্ধা নামধারী বহু রিকশাচালককে লাইনে দাঁড় করিয়ে টাকা নিয়ে তিনি সনদটি রিকশাচালককে দিয়ে দিতেন। রিকশাচালক সনদ উচ্চমূল্যে অমুক্তিযোদ্ধা শিক্ষিতদের কাছে বিক্রি করে দিত। যা দেখিয়ে ১৯৭৩ সালের বিসিএসে অনেকে চাকরি বাগিয়ে নিয়েছেন। ড. বি. করিমের লেখায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি নকল মুক্তিযোদ্ধাদের ঠেকানোর জন্য ১৯৭২ সালেই সরকারকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি ও জীবনবৃত্তান্ত দিয়ে গেজেট প্রকাশের পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু নানা অসুবিধায় সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
১৯৭৫ সালের পরে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সুপারিশের ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যেও অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা নিয়োগ পান। ২-১ জন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্যাড ছাপিয়ে নিজেই স্বাক্ষর করে সুপারিশপত্র জমা দিয়ে চাকরি গ্রহণ করেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু হয় স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে। তখন অনেক মুক্তিযোদ্ধা ইচ্ছা করেই তালিকায় নাম লেখাননি। তখন শ্রীনগর উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন মাত্র ৭৩ জন।

১৯৯১-৯৫ সালে বেগম খালেদা জিয়ার সময়ে একবার লৌহজংয়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইকালে জাতীয় পার্টির ভোট ডাকাতির এমপি ইকবাল হোসেন শ্রীনগরের মুক্তিযোদ্ধাদের পিস্তল উঁচিয়ে ধাওয়া করেন। তখন তিনি শ্রীনগরের ৪০-৫০ জন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার নাম লাল মুক্তিবার্তা থেকে কেটে দেন। যার ফলে শ্রীনগর উপজেলার অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার নাম লাল মুক্তিবার্তায় ছাপা হয়নি।

১৯৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি করার কাজে হাত দেয়। তখন আমি শ্রীনগর উপজেলার যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে দেখেছি যে, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডারদের থেকে প্রত্যয়নপত্র এনে অনেক অমুক্তিযোদ্ধা নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবি করছেন। অথচ তারা মুক্তিযোদ্ধা নন। এমন অনেকে আমার ভূমিকায় তালিকাভুক্ত হতে পারেননি। ফলে তারা অনেকে আমার প্রতি চরম অসন্তুষ্ট হন।

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এসে আবার মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়ন শুরু করে। সে আমলে আমাকে যাচাই-বাছাই কমিটিতে না নিলেও আমি লক্ষ্য করেছি যে, যাচাই-বাছাই কমিটিতেই নকল মুক্তিযোদ্ধার স্থান হয়েছে। তা ছাড়া উপজেলা, জেলা ও কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতৃবৃন্দের ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের লোভ-লালসার কারণে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে।

তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধির প্রবণতা শুরু হয় কর্মরত মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরিকাল দুই বছর বৃদ্ধি করার ঘোষণার পরে। সন্তান, নাতি-নাতনিদের চাকরিতে কোটা ও সম্মানী ভাতা প্রদানের সিদ্ধান্তের ফলে অনেকে মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও নানা উপায়ে মুক্তিযোদ্ধা সেজে সুবিধা নিতে নেমে পড়েন। অনেকে উপজেলা সংসদের কমান্ডার বা মুক্তিযোদ্ধাদের যোগসাজশে মুক্তিযোদ্ধা বনে গিয়ে ছেলেমেয়েদের কোটায় চাকরিতে নিয়োগ দিতে সক্ষম হন। চারজন সচিবের নাম, ছবি আমরা প্রচারমাধ্যমে দেখেছি- যারা মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও মুক্তিযোদ্ধা সেজেছিলেন। আমার উপজেলার ৪-৫টি ইউনিয়নে অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেনÑ তাদের তো আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি ও জানি।

গত বছর গঠিত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সভাপতি হিসেবে আগের কমিটির সুপারিশ পুনঃমূল্যায়ন করতে হয়েছে। কিন্তু যাচাই-বাছাই করার সুযোগ পাইনি। যাদের নিয়েই কমিটি হোক তাদের কাছে আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ থাকবে, প্রকৃত কোনো মুক্তিযোদ্ধা যেন বাদ না পড়ে। আর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত না থেকেও শুধু সুবিধা নেয়ায় জন্য যারা কাগজপত্র জোগাড় করে মুক্তিযোদ্ধা সেজেছেনÑ তারা যেন কোনো অবস্থাতেই তালিকাভুক্ত হতে না পারেন। গত ৫ ডিসেম্বর, ২০২০ শ্রীনগর গিয়ে জানতে পারি যে, আমাদের গ্রুপের ২৬ জনের মধ্যে ৯ জনের যাচাই-বাছাই হবে। যা শুনে আমি ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ি। গত ১১ ডিসেম্বর জামুকার বিজ্ঞপ্তিতে সুনির্দিষ্টভাবে স্পষ্ট করা হয়েছে যে, যাদের নাম ভারতীয় তালিকা ও লাল মুক্তিবার্তায় রয়েছে তাদের যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন হবে না। তাই আমরা এখন অনেকটা চিন্তামুক্ত। কিন্তু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা তথ্যের অভাবে বাদ পড়ে যান কিনা- সে জন্য আমি চিন্তিত। ভারতীয় তালিকা ও লাল মুক্তিবার্তায় নাম আছে এমন মুক্তিযোদ্ধাদের নাম জামুকা কর্তৃক ইউএনও/ডিসির কাছে প্রেরিত তালিকা থেকে বাদ দেয়া প্রয়োজন।মো.

জয়নাল আবেদীন : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও গবেষক।

The post ৪২ হাজার মুক্তিযোদ্ধার সনদ যাচাই প্রসঙ্গে appeared first on Bhorer Kagoj.

0 Comments

There are no comments yet

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

twelve − 10 =

Back to top