হাবীবুল্লাহ সিরাজীর জীবন ও কাব্যশৈলী

রহীম শাহ

ষাটের দশকের অন্যতম কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। বাংলা ভাষার বিশাল কাব্যভাণ্ডারে ঔজ্জ্বল্যে দ্যুতি ছড়ান তিনি। বাংলা ভাষার প্রতিটি পাঠক জানেন, কত কুশলী ছিলেন এই কবি। কাব্যভাষায় তিনি বারবার কৌশল পরিবর্তন করেছেন; তার কবিতার বুনন, ভাষাশৈলী, উপস্থাপনকলা এমনকী বিষয় নির্বাচনে তার মুনশিয়ানা চোখে পড়ার মতো। কবিতার ভাষাশৈলীর পরিবর্তন পাঠককে শুধু বিমোহিত করে না, চিন্তার খোরাকও জোগায়। কবিতার নিরবচ্ছিন্ন সচেতন নির্মিতি প্রত্যক্ষ করতে অনুসন্ধিৎসু পাঠককে এই কবির শরণাপন্ন হতে হয়েছে গত পাঁচ দশক ধরে। পাঠককে চমকে দেওয়ার মতো কাব্যমেধা যে তার আছে, এ কথা অনস্বীকার্য। পাশাপাশি কবিতা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিজের কবিতাকে অনন্য এক উচ্চতায় পৌঁছে দেওয়ার সামর্থ্যও তার মধ্যে অপরিসীম।

হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতার উচ্চতা তার সময়ের অন্য অনেক কবির চেয়েই স্বতন্ত্র। এ স্বাতন্ত্র্যের কারণে অনেক সমালোচক তাকে এড়িয়ে যান, তার কবিতাকে এড়িয়ে যান। কবিতার গভীর সৌন্দর্য আবিষ্কারের জন্য যে প্রস্তুতি একজন সমালোচকের থাকা প্রয়োজন তেমন সামর্থ্য এখন খুব একটা নেই। এ কারণেই হয়তো বোধগম্যহীনতার কারণেই অনেক ক্ষেত্রে হাবীবুল্লাহ সিরাজী অনালোচিত থেকে যান।

স্বীকার করছি, এ বোধগম্যতা আমারও নেই। আমি কবিও নই, সমালোচকও নয়। কিন্তু কবিতার প্রতি আমার উদগ্র আকর্ষণের কারণে স্বতন্ত্রধারার এই মগ্ন কবিকে আবিষ্কারের চেষ্টা করি।

কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। তার কবিতায় শৈল্পিক সিদ্ধির পাশাপাশি রয়েছে বিষয়ভাবনার সুগভীর বৈচিত্র্য।

ব্যক্তির একান্ত মনলোককে যেমন তিনি নৈর্ব্যক্তিক ব্যঞ্জনায় প্রতিভাসিত করেন তেমনি সময়-সমাজ-দেশ ও বিশ্বপরিস্থিতির অনায়াস উদ্ভাসন ঘটে তার পঙ্ক্তিঘরের অবয়বে আর অন্তর্গূঢ় অনুভাবনে।

এদেশের সংগ্রামশীল ইতিহাস ও মানুষ, মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং প্রগতির অভিযাত্রা-রেখা ভাস্বর তার প্রায় অর্ধশত কবিতা বইয়ে।

শুধু কবিতা নয়, হাবীবুল্লাহ সিরাজীর গদ্য যেন তার কবিতারই সহোদরা, আবার তা স্বতন্ত্রও বটে। বিবরণমূলক গদ্যধারার বিপরীতে হৃদয়ী সংবেদনে বিচিত্র-বর্ণিল-ব্যতিক্রম তার প্রাবন্ধিক গদ্যগুচ্ছ; যা ধারণ করেছে বাংলা ও বিশ্বসাহিত্য-সংস্কৃতির নানা প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ। তার আখ্যানমূলক ও আত্মজৈবনিক রচনাও অনন্যতার দাবিদার।

এ ছাড়া অনুবাদ তার আর এক প্রিয় ভুবন যেখানে রুমী কিংবা রসুল হামজাতভকে আমরা বাংলায় পাই তার কারুকলমে। শিশুকিশোর সাহিত্যে হাবীবুল্লাহ সিরাজী স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল। আধুনিকমনষ্ক নতুন প্রজন্মের বোধে বিশেষ প্রিয়তায় ধরা দেয় তার ছড়া, কবিতা এবং এ জাতীয় শিশুতোষ-কৈশোরক রচনা। সব মিলিয়ে বাংলা সাহিত্যে হাবীবুল্লাহ সিরাজী এক বিশিষ্ট নাম, যার বিবিধ রচনা অনূদিত হয়েছে বহু বিদেশি ভাষায়।

হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য, তার পরিমিতিবোধ, বুননরীতি, শব্দচয়নে স্বাতন্ত্র্য, নির্মাণশৈলীর কুশলী গ্রন্থনা, ছন্দবিন্যাসে নিষ্ঠা এবং সর্বোপরি দৃশ্যের অধিক বাক্সময় করার মুনশিয়ানা ইত্যাদি অনুষঙ্গের কথা আরো একবার স্মরণ করে নিতে চাই। অচেনা ভুবনে ভ্রমণের আগে সেখানকার আবহাওয়া-জলবায়ু-পরিবেশ-পরিপার্শ্ব যেমন জেনে নেয়া আবশ্যক; এ-ও অনেকটা তেমনি। হাবীবুল্লাহ সিরাজী সহজ-সরল ভাষায় কাব্যচর্চা করেন না। সুতরাং যেখানে আড়াল থাকবে, সেখানে উন্মোচনের প্রচেষ্টা থাকতে হবে; যখন বিমূর্ততার ঘোমটা থাকবে তখন অন্তরালকে মূর্ত করে নেয়ার প্রস্তুতি থাকতে হবে; যখন গতির ক্ষিপ্রতা থাকবে, সে ক্ষিপ্রতাকে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার গৌরব অর্জনের প্রয়োজন হবে। জটিল গ্রন্থি উন্মোচনের আনন্দ সহজপ্রাপ্য হবে তেমনটি আশা করাও অন্যায়। সিরাজীকাব্য পাঠে মস্তিষ্কের গ্রন্থিগুলোকে সজাগ রাখার পাশাপাশি হৃদয়ের কপাটগুলোকে শিথিল করে নেয়া ভালো। হৃদয়সংবেদী পাঠে উন্মোচিত হবে দুর্ভেদ্য সব অন্ধকার।

প্রকৌশল শাস্ত্রের সঙ্গে কাব্যচর্চার কোনো বিরোধ নেই। কিন্তু প্রকৌশলীদের কবি হওয়ার প্রবণতা অনেকটাই কম। সেখানেও হাবীবুল্লাহ সিরাজী যতটাই প্রকৌশলী ততটাই অথবা তারচেয়ে কিছুটা বেশিই কবি। হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতার স্বাতন্ত্র্যের সন্ধান পেতে প্রথমত তার প্রকাশিত কাব্যের তালিকার দিকে দৃষ্টি দিতে পারি। ধারণা করি গ্রন্থ তালিকা দেখেই পাঠক মোটা দাগে তার কাব্যচারিত্র্যের সন্ধান পেয়ে যাবেন, আর যারা তার কাব্যসৌন্দর্যের গলিঘুপচি আবিষ্কারে আগ্রহী তাদের প্রবেশ করতে হবে তার কাব্যভুবনের অন্দরে। এককথায় হাবীবুল্লাহ সিরাজী কবিতা ও কর্মে মুক্তিযুদ্ধ এবং প্রগতিশীলতাকে তুলে ধরেছেন, যা পাঠকমহলে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

The post হাবীবুল্লাহ সিরাজীর জীবন ও কাব্যশৈলী appeared first on Bhorer Kagoj.

0 Comments

There are no comments yet

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three × 2 =

Back to top