চট্টগ্রামে জলজট সমন্বয়হীনতায়

বর্ষার জলে হাবুডুবু দেশের ‘বাণিজ্যিক রাজধানী’ খ্যাত বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। নগরী ও এর আশপাশকে ঘিরে নানা উন্নয়ন প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ চলছে ঠিকই; কিন্তু এসব কাজের সুফল পাওয়ার আগেই তা ডুবে যাচ্ছে পানির নিচে। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। জলাবদ্ধতা নিরসনে হাজার কোটি টাকার প্রকল্প তিনি অত্যন্ত দ্রুত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদে (একনেক) পাস করিয়ে দিয়েছেন। অর্থও বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু জলজটের দুর্ভোগ থেকে নিস্তার মিলছে না নগরবাসীর। বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতার অভাব ও নেতৃত্বহীনতার কারণেই বছরের পর বছর ধরে জলাবদ্ধতার দুর্ভোগে নাকাল হচ্ছেন চট্টগ্রামবাসী।

জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক), চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক), পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবি), চট্টগ্রাম ওয়াসা নানা প্রকল্পে কাজ করছে। কিন্তু এসব প্রকল্পের মধ্যে প্রকৃত ক্ষমতা বা অভিভাবকত্ব নিয়ে যে সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রকল্প সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা দরকার- সে দায়িত্ব সত্যিকার অর্থে কাউকেই দেয়া হয়নি। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী বা বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের মেয়রের পদমর্যাদা মন্ত্রী পর্যায়ের না হওয়ায় তিনি তেমনভাবে কোনো কাজ করতে পারছেন না। নগর পরিকল্পনাবিদসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নাগরিকদের অভিমত, স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে মেয়রকে সেই পদমর্যাদা ও দায়িত্ব দেয়া হলে সমন্বয়ের মাধ্যমে নগরীর জলাবদ্ধতাসহ অন্যান্য উন্নয়নকাজের গতিশীলতা বাড়বে। কারণ মেয়র বিভিন্ন সেবা সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে সমন্বয় সভা ডাকেন, কিছু সিদ্ধান্তও নেন। কিন্তু তা বাস্তবায়নে কোনো সংস্থারই কারো কাছে কোনো জবাবদিহিতা নেই। ফলে কাজের কাজ কিছুই হয় না।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ নামে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প ২০১৭ সালের ৯ আগস্ট একনেকে অনুমোদন দেয়া হয়। এরপর নগরীর শাহ আমানত সেতু থেকে কালুরঘাট সেতু পর্যন্ত কর্ণফুলী নদীর তীর দিয়ে একটি বেড়িবাঁধ কাম মেরিন ড্রাইভওয়ে, স্লুইসগেট নির্মাণ ও জলাবদ্ধতা নিরসনে আরো প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প দেয়া হয়। সেটির কাজও চলছে। অন্যদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডও প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ করছে। সংস্থাটি চট্টগ্রাম মহানগরীকে বন্যা, জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ত পানি থেকে রক্ষা করতে এই কাজ করছে বলে জানা গেছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনও বহদ্দারহাটের বারুইপাড়া এলাকা থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত নতুন একটি খাল খননের জন্য সরকারের কাছ থেকে প্রকল্প পাস করিয়েছে। কিন্তু ফান্ড পাওয়াসহ নানা জটিলতায় তা আটকে আছে। এসব প্রকল্পের নির্দিষ্ট সময়ের মেয়াদ শুধুই বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু কাজের অগ্রগতি নেই তেমন। কারণ এজন্য সমন্বয় এবং জবাবদিহিতার কোনো বালাই নেই।

এরই মধ্যে চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান থাকায় নগরের বেশকিছু খালের বিভিন্ন পয়েন্টে বাঁধ দেয়া হয়েছে। এ কারণে বৃষ্টির পানি সহজে নামতে পারছে না। এতে অল্প বৃষ্টিতেই সৃষ্টি হচ্ছে জলজট। আবার জোয়ারের পানিও ঢুকছে বিভিন্ন খাল দিয়ে। ফলে তলিয়ে যাচ্ছে নগরীর আবাসিক-বাণিজ্যিকসহ বিভিন্ন এলাকা। তবে গত ১৪ জুন মেয়র রেজাউল করিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সমন্বয় সভায় এসব বাঁধ আগামী ৩০ জুনের মধ্যে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

নগরীর জলাবদ্ধতার কারণ ও সমাধান সম্পর্কে চসিক মেয়র রেজাউল করিম গতকাল শুক্রবার ভোরের কাগজকে বলেন, খালে বাঁধের কারণেও জলাবদ্ধতা হচ্ছে বৃষ্টির সময়। তাছাড়া কর্র্ণফুলী নদীর পরিকল্পিত খনন না করায় নাব্যতা কমে যাওয়ায় জোয়ারের পানিতেও সয়লাব হচ্ছে নগরী। তিনি বলেন, নালা-নর্দমা, খাল-নদীসহ সর্বত্র নির্বিচারে পলিথিন ফেলে পানির স্বাভাবিক চলাচল রুদ্ধ করে দেয়া হচ্ছে। পাহাড় কাটাও বন্ধ নেই। পাহাড়ের মাটি, বালু বৃষ্টির পানিতে ভেসে এসে এসব খাল-নালা ভরাট করে দিচ্ছে। এটিও জলজটের অন্যতম কারণ। মেয়র বলেন, পলিথিন উৎপাদন বন্ধে চসিক অভিযান শুরু করবে। পাশাপাশি মেয়র আর এস এবং সি এস সিট অনুযায়ী খাল খননের পাশাপাশি বিলীন এবং দখল হওয়া খাল পুনরুদ্ধারে উদ্যোগ নেয়ার কথাও বলেন। তিনি বলেন, চলমান মেগা প্রকল্পের কর্মকর্তারা চসিকের স্থানীয় কাউন্সিলরদের মতামত ও তাদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করলে গতিশীলতা বাড়বে।

চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার বিষয়ে গতকাল চউকের চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষের বক্তব্য জানার জন্য তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। তবে গত ১৪ জুনের সভায় তিনি বলেছেন, আমরা সব সেবা সংস্থা সমন্বিতভাবে কাজ করতে চাই। একে অন্যকে দোষারোপ করলে কাজ হবে না। খালে কাজের জন্য যে বাঁধ দেয়া হয়েছে তা চলতি মাসের ৩০ তারিখের মধ্যে অপসারণ হবে। ওই দিনের বৈঠকে চউকের জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব দেয়া সংস্থা সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের প্রকল্প কর্মকর্তা মেজর পঙ্কজ মল্লিক বলেন, সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেড জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করছে। প্রকল্পের কাজে চউক ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সমঝোতা চুক্তি হয়েছে ৩ হাজার ৮৪০ কোটি টাকার। এর মধ্যে আমরা পেয়েছি ১ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। ৩৬টি খালের মধ্যে আমরা অর্ধেক খালের কাজ করেছি। বাকি অর্ধেক খালের কাজ এখনো বাকি। ড্রেনের কাজ করেছি মাত্র ২৬ কিলোমিটার। কাজেই এখনি বেশি কিছু আশা করলে ভুল হবে।

নগর পরিকল্পনাবিদ ও পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরাম নেতা প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার ভোরের কাগজকে বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাব, অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব না দেয়া, সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের প্রচণ্ড অভাব, নেতৃত্বহীন-জবাবদিহিতাহীন কর্মকাণ্ডের ফলে জলাবদ্ধতা নিরসন অনেকটা সুদূর পরাহত হয়ে পড়েছে।

The post চট্টগ্রামে জলজট সমন্বয়হীনতায় appeared first on Bhorer Kagoj.

0 Comments

There are no comments yet

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

one × three =

Back to top