নতুন বাজেট ঘোষণা : নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টানবে কে?

দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে বাজেট এবং জীবনযাত্রার সম্পর্ক অতি নিবিড় ও বাস্তব। একটি পরিবার কীভাবে তাদের দৈনন্দিন জীবনকে নির্বাহ করবে তা নির্ভর করে তাদের আয়, চাহিদা এবং দ্রব্যমূল্যের ওপর। প্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের মূল্য যখন সহনীয় পর্যায়ে এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে তখন তাদের জীবন কাটে স্বস্তিতে। অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য যখন সাধারণ মানুষের আর্থিক সঙ্গতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে যায় তখন দরিদ্র এবং অতিদরিদ্র পরিবারে চলে অর্ধাহার, অনাহার এবং পারিবারিক অশান্তি। তাই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে একদিকে জনজীবনে নেমে আসে কষ্টের কালো ছায়া। অন্যদিকে মুনাফাখোরি, কালোবাজারিদের কারণে দেশে বিরাজ করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। জাতীয় বাজেট হচ্ছে রাষ্ট্রের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের আয়-ব্যয়ের একটি বিশদ পরিকল্পনা ও আর্থিক বিবরণী। অনেক সময়ই কাগজের বিবরণী আর বাস্তব বিবরণীর বড় রকমের গরমিল লক্ষ করা যায়। এ গরমিলে ভারসাম্য আনার দায়িত্ব সরকারের বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের। সমন্বিত কর্মপ্রচেষ্টায় তা গণমুখী হয়ে উঠতে পারে। অন্যথায় তা জনকল্যাণ না হয়ে জনগণের দুর্ভোগের ইস্যুতে পরিণত হবে। সারা বিশ্বের অর্থনীতির ক্রান্তিকাল চলছে। একটি বাজেটের মূল লক্ষ্য হচ্ছে সম্পদের পুনর্বণ্টন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং আয় বাড়ানোর মাধ্যমে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা। এ লক্ষ্য পূরণে প্রতি অর্থবছরে বাজেটের আয়তন বাড়ছে। এবারের বাজেটে সরকারের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে রাজস্বের পরিমাণ বাড়ানো। যদিও বিভিন্ন জায়গায় করের পরিধি বিস্তৃত করা হয়েছে। সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক টানাপড়েন বিরাজ করছে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশকে কোনোভাবেই উচ্চাভিলাষী বাজেটের ভাবনায় তাড়িত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
বাজেটে দরিদ্র মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তামূলক নানা কর্মসূচি থাকলেও মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য ক্রান্তিকাল অতিক্রমের জন্য কোনো দিকনির্দেশনা নেই। কিন্তু অর্থনীতিতে চাহিদা তৈরির নেপথ্যের এই কারিগরদের রক্ষা করা না গেলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সফল হবে না। মধ্যবিত্তরা সমাজকে টিকিয়ে রাখে। এই মাঝের স্তরটির অবক্ষয়ের অর্থ সমাজের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়া। এবারের বাজেটে মধ্যবিত্তের জন্য তেমন কোনো সুখবর নেই। জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল। চলতি বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে আগের বছরের চেয়ে বরাদ্দ ১৩ শতাংশ বেড়েছে। নতুন করে কত লাখ মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আনা হবে? নগর দরিদ্রসহ আড়াই কোটি নতুন দরিদ্রের জন্য তা নিতান্তই অপ্রতুল। উপরন্তু বরাদ্দকৃত অর্থের বেশিরভাগ অংশ সরকারি কর্মচারীদের পেনশন, সঞ্চয়পত্রের সুদ প্রভৃতি পরিশোধে চলে যাবে। সরকারি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, যোগ্য না হয়েও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ভাতা নেন ৪৬ শতাংশ সুবিধাভোগী। জনসংখ্যার সঠিক ডাটাবেজ না থাকায় এবং অনিয়মের কারণে অনেকে যোগ্য হয়েও কর্মসূচি থেকে বাদ পড়ছেন। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অতিমারিতে ক্ষতিগ্রস্ত মধ্যবিত্তদের রক্ষা না করলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার বাধাগ্রস্ত হবে। নানা টানাপড়েনে মধ্যবিত্ত সংকুচিত হয়ে আসছে এবং এই প্রবণতাকে উদ্বেগজনক বলে মনে করা হচ্ছে। করোনা মহামারিতে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত অনেকেই নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। এসএমই খাতের মাধ্যমে আমাদের জিডিপির ২৫ শতাংশ তারাই অবদান রাখে। কিন্তু যে কোনো ধরনের অর্থনৈতিক নীতিমালা গ্রহণের ক্ষেত্রে বিশাল এই জনগোষ্ঠী উপেক্ষিত হয়। তারা কোনো প্রভাবশালী গোষ্ঠী নয়। বাজেট প্রণয়নের সময় তাই তাদের পক্ষে বলার কেউ নেই। যারা উচ্চবিত্ত, বড় ব্যবসায়ী, তারা দরকষাকষি করতে পারে, এমনকি তারা সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও আছে।
নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব যদি যথাযথ কর্তৃপক্ষ ঠিকমতো বাজার ব্যবস্থাপনার দিকে নজরদারি জারি রাখে। মধ্যস্বত্বভোগীদের মুনাফাখোরি মানসিকতা বদলাতে হবে। তাদের মুনাফাবাজির তৎপরতায় উৎসাহ দেয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। দাম চড়িয়ে দিলে ভোক্তাদেরও সচেতন হয়ে ভোগের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে। উৎপাদন, আমদানি ও বাজারে সরবরাহে সমন্বয় ঘটাতে হবে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর বিষয়টি আজ নতুন নয়। অসৎ ব্যবসায়ী, কালোবাজারি ও মুনাফালোভীদের কারণে এসব ঘটে। এ জন্য সরকারের সদিচ্ছা ও মনিটরিং ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে সারা বছর। পণ্য বাজারে সরকারের নজরদারি ও সামাজিক সচেতনতা তৈরি করতে হবে। নিয়মিত মনিটর করতে হবে এবং ভ্রাম্যমাণ আদালত বসাতে হবে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ বহুবিধ, অপরিকল্পনাও দায়ী। সংকট তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু মানুষ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পণ্য আটকে দেয় এবং দ্বিগুণেরও বেশি দামে বিক্রি করে। আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে আনা দরকার। চাহিদা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলে নিত্যপণ্যের দাম নাগালে রাখা সম্ভব হবে। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে হতে হবে আরো কঠোর ও দায়িত্বশীল। গ্রামীণ পর্যায়ে কৃষকদের ঋণদানসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে, যাতে তারা সহজে পণ্য বাজারজাত করতে পারে এবং ন্যায্যমূল্যে উৎপাদিত পণ্য বিক্রয় করতে পারে। সরকারকে প্রতিটি পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিতে হবে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এতে করে দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার আয়ত্তে থাকবে। সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার চেষ্টা চালালেও কিছু মুনাফালোভী ব্যবসায়ীর জন্য তা বারবার হোঁচট খাচ্ছে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের লোকজনের গাফিলতির কথা শোনা যায়। আবার নিয়মিত মনিটরিংয়ের অভাবের কথাও জানা যায়। ফলে দায়ী ব্যবসায়ীরা যেমন পার পেয়ে যান, তেমনি আবার একই ধরনের অপকর্মে যুক্ত হয়ে পড়েন।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়া দরকার। প্রথমত, সরকারের সদিচ্ছা ও বাস্তব পরিকল্পনা। দ্বিতীয়ত, পণ্যসামগ্রীর চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার ব্যবস্থা করা। এ জন্য দেশে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে হবে। দেশের উৎপাদন ব্যবস্থার পুরোপুরি সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পণ্যবাজারের ওপর সরকারের সজাগ দৃষ্টি রাখা দরকার, যেন অসাধু ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি করে খুশিমতো জিনিসপত্রের দাম বাড়াতে না পারেন। রাজনৈতিক সহনশীলতা ও সমঝোতা সৃষ্টি করে এ সমস্যা লাঘব করা দরকার। চোরাচালান ও চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। বাজার নিয়মিত পরিদর্শন করতে হবে। দুর্নীতির লাগামহীন ঘোড়াকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। সরকারকে কঠোর হাতে অতিলোভী অসাধু এসব ব্যবসায়ীকে দমন করতে হবে। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য তালিকা টাঙানো এবং নির্ধারিত মূল্যে পণ্য বিক্রয় করা হচ্ছে কিনা, সেটি পর্যবেক্ষণের জন্য সব বাজারে দ্রব্যমূল্য মনিটরিং কমিটি গঠনের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার ও ব্যবসায়ীদের সদিচ্ছাই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করে দেশের সাধারণ মানুষের আরো একটু সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা প্রদানে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে সক্ষম। মুনাফালোভী, কালোবাজারি ব্যবসায়ী শ্রেণি, ঘুষখোর কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করতে হবে। পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, মুদ্রাস্ফীতি কমিয়ে আনতে হবে। তাহলেই দ্রব্যের মূল্য হ্রাস পাবে।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি ও নতুন বছরের বাজেট ঘোষণা কতটা গণমুখী হবে- আর গণমুখী হলেও তাতে সাধারণ ও খেটে-খাওয়া মানুষের বেঁচে থাকার মতো কোনো নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবিলার কোনো ব্যবস্থা থাকছে কিনা? এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে দুটি মতের ধারা প্রাধান্য পেয়ে থাকে- এক গ্রুপের অভিমত হচ্ছে- এ বাজেটে মানুষের অসহায়ত্ব ও হাহাকার বাড়াবে, অন্যদিকে সুবিধাভোগী শ্রেণির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য ইস্যুর সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিভিন্ন মহলে পারস্পরিক অবিশ্বাস, স্বার্থপরতা, লোভ-লালসা, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, বাজার অর্থনীতি মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে বাজেট এবং বাজার নিত্যপণ্যের মূল্য কতটা নিয়ন্ত্রণে থাকবে সেগুলো সাধারণ মানুষকে খুব ভাবাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি বিশ্ববাজারকে অনেকটাই অস্থিতিশীল করে তুলেছে। কাজেই বাংলাদেশের প্রস্তাবিত বাজেটে আমাদের নিত্যপণ্যের যে ঊর্ধ্বগতি তার লাগাম টেনে ধরবে কী? বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাজার ও বাজেট বাস্তবায়নের মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান জরুরি। অন্যথায় আর্থসামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। বিশ্ব অর্থ ব্যবস্থা যে ইঙ্গিত দিচ্ছে তাতে মনে হয় আগামী বাজেট বাস্তবায়ন খুবই চ্যালেঞ্জমুখী হবে। দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান ও ক্ষুদ্র ব্যবসার উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা ছাড়া মানুষের জীবন মানের কোনো পরিবর্তন আসবে না, বরং বেঁচে থাকাই একটি চ্যালেঞ্জের বিষয় হবে। তবে বাজেট যেভাবেই প্রণীত হোক না কেন তাকে গণমুখী করা তথা সমাজের সব শ্রেণি ও মানুষের স্বার্থে আঘাতহানিকর প্রকল্পগুলোর ব্যয় নির্বাহে আমাদের খুবই সজাগ থাকতে হবে। এক্ষেত্রে বাজেট ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাকে নজরে আনতে হবে। বিশ্ব মুদ্রাস্ফীতি, মূল্যস্ফীতি, বাজার নিয়ন্ত্রণসহ সব স্টেকহোল্ডারগণের নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে কার্যকর ব্যবস্থায় অবতীর্ণ হতে হবে।

ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ : কলাম লেখক ও গবেষক।
forqan.info@gmail.com

The post নতুন বাজেট ঘোষণা : নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টানবে কে? appeared first on Bhorer Kagoj.

0 Comments

There are no comments yet

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

four × 3 =

Back to top